মুদ্রাস্ফীতি;-
একটি দেশের রিজার্ভে ডলারের পরিমাণের উপর নির্ভর করে সে দেশের মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি ঘটার কারনে একটি দেশের ভিত নড়েবড়ে হয়ে যেতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে যেতে পারে ভঙ্গুর।
আমরা সাধারণ ভাষায় বলতে পারি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে পরিবারের যা অবস্থা হয় ঠিক একটি দেশের অবস্থা ও ঠিক তেমনিই হয়।
ঋণের বোঝা হতে থাকি সুবিশাল। সেই সেদিনের ভাগীদার থাকি সারা দেশের মানুষ। অর্থাৎ দেশের সবাই তখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
মুদ্রাস্ফীতির কারণ সমূহ ;-
পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যারা কোনো শস্য উৎপাদন করে না। কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদে খাবার গ্রহণ করতেই হয়। যেহেতু তাদের শস্য উৎপাদন করা হয় না তাই তারা সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর হয়ে থাকে। পৃথিবীতে আমদানি রপ্তানির জন্য প্রয়োজন হল টাকার। যখন রপ্তানি আয় না থাকে এবং আমদানি আমদানির পেয়ে অনেক বেশী হয়ে থাকে তখন দেশে রিজার্ভে টাকা শেষ হতে থাকে।
বর্তমানে একটা দেখতে পাচ্ছে শ্রীলঙ্কা মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছে। শ্রীলংকার প্রত্যেকটি নাগরিকের মাথাপিছু বিশাল অংকের ঋণ আছে। সরকার তাদের দেশের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে থাকে। এত রিজার্ভের যখন ডলার না থাকে তখন সেই ঋণ পরিশোধ সম্ভব হয়না ।
তখন সে দেশ বা প্রতিষ্ঠান যে কাজের জন্য বা প্রোজেক্টের জন্য টাকা দিয়েছিল সেই প্রজেক্ট কিংবা প্রতিষ্ঠান কি তারা নিজেদের হিসেবে ঘোষণা করে। একটি দেশের অভ্যন্তরে আরেকটি দেশ বা প্রতিষ্ঠানের যখন কোন প্রজেক্ট বা প্রতিষ্ঠান কি নিজেদের হিসেবে ঘোষণা দেয় তখন সেই দেশকে দেউলিয়া হিসেবে ধরা হয়।
মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণসমূহ;-
1. অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হওয়া।
2. আমদানি নির্ভর হয়ে পড়া।
3. রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়া।
4. অর্থপাচার।
5. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
6. দুর্নীতি ও অর্থলোট ইত্যাদি।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হওয়া;-
খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশের শিল্প ও অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংকট দেখা যায়। যার ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানি করার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলারের রিজার্ভ রাখতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের জন্য ডলার ব্যবহার করা হয়।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যদি ডলারের পরিমাণ কমে যায় তখন দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে সেদেশের টাকার মান কমে যায়। এর ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হয়ে যায়।
আমদানি নির্ভর হয়ে পড়া;-
কোন দেশ যখন সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে তাদের দেশের বিশাল অঙ্কের টাকা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যায়। এতে করে সে দেশের টাকার মান ডলারের বিপরীতে অনেক কমে যায়।
এর ফলে সে দেশের টাকার মান কমে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। একারণেই পৃথিবীর সব দেশ আমদানি এবং রপ্তানি সমান রাখার চেষ্টা করে। এতে ফলারের বিপরীতে সেই দেশের টাকার মান কমে যায় না।
রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়া;
একটি দেশের অর্থনীতিতে আমদানি এবং রপ্তানিকারক প্রভাব রাখে। আমদানি রপ্তানি মাঝখানে সামঞ্জস্য না থাকলে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। একটি দেশের অর্থনৈতিক ভীত কে শক্ত করে সেই দেশের রপ্তানি।
আমদানি বেশি আর রপ্তানি কম হলে সেই দেশের পন্য উৎপাদন কম হলে দেখা দিতে পারে মুদ্রাস্ফীতির।
অর্থপাচার;-
দেশের ভিতরে থাকা কিছু "ঘরের শত্রু বিভীষন" এরা দেশের টাকা লোট করে নিজেদের কথা ভেবে অঢেল অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। এতে করে দেশের অভ্যন্তরীণ টাকার মান কমতে থাকে। ফলে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ফলে দেশের অর্থনৈতিক ভীত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা;-
একটি দেশকে পরিচালনা করে সেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। সরকার গঠন করার উদ্দেশ্য নিয়ে তারা জনকল্যাণমুখী কাজ ও দেশের উন্নয়ন করে থাকে।
কিন্তু কিছু কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের লাভের আশায় দেশকে অস্থির করে তুলে।
তাদের এই মনোভাবের কারনে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বানিজ্য এবং বিদেশে রপ্তানি আমদানিতে বিশাল প্রভাব পড়ে। আমদানি রপ্তানিতে প্রভাবের কারনে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দুর্নীতি ও অর্থলোট;-
দেশের উন্নয়ের জন্য জনগণ ভোট দিয়ে নেতেদের হাতে দায়িত্ব দেয় দেশ পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু সেই নেতারাই যখন দুর্নীতি করে নিজেদের দেশকে ভিতর থেকে ফোকলা করে দিচ্ছে। তাদের এই অর্থ কেলেংকারির বুঝা বইতে হচ্ছে দেশের সর্বোপরি জনগণকে। দেশ ও জনগণের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু রাজনীতিবিদেরা।
এ রাজনীতিবিদেরাই অর্থপাচার ও দেশকে অস্থিতিশীল করার পেছনের মূল হোতা। স্বচ্ছ সরকার এবং জবাবদিহিতা থাকলে অসাধু রাজনীতিবিদেরা দেশকে লুট করতে পারত না। হলে দেশ হয়ে উঠত স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দেশে কোনো মূল্যস্ফীতি ঘটতো না।
শ্রীলংকার বর্তমান অবস্থা ;-
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা এখন দেউলিয়া। তার প্রধান কারণ সেখানকার বর্তমান সরকারের দুর্নীতি অর্থ লোট এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন। জনগণকে দেখানোর জন্য শ্রীলংকা সরকার চীনের কাছ থেকে বিশাল অংকের টাকা ঋণী সব বিলাসবহুল প্রোজেক্ট হাতে নেয়। কিন্তু তাদের উৎপাদন সক্ষমতা এবং রপ্তানি আয়ের দিকে তাদের কোনো নজরই ছিলনা।
সরকারদলীয় লোকজন এবং ক্ষমতাবানরা নিজেদের মতো দেশের অর্থনীতি করে বিদেশে পাচার করে দেশ কে দেউলিয়া করেছে।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ;-
আমাদের বাংলাদেশেও আমরা মুদ্রাস্ফীতি দেখতে পাই। প্রায় প্রত্যেক বছরই আমাদের দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশ ছুই ছুই থাকে। যদিও বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে একপ্রকার অসাধু ব্যবসায়ী যারা কিনা মজুতদার।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য তারা মজুদের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ উৎপাদনশীল দেশ তারপরেও আমাদের দেশে দেখা দেয় দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী দাম। আমাদের রপ্তানি আয় আমাদের উৎপাদন সবকিছু অনুকূলে থাকার পরেও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলব আমাদের এই মুদ্রাস্ফীতির পেছনে রয়েছে দেশেরই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার, রাজনীতিবিদ এবং কিছু অর্থ পাচারকারী দালাল।
বাংলাদেশ কি পরবর্তী শ্রীলংকা হতে যাচ্ছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সাদামাটা। বাংলাদেশ উৎপাদনশীল দেশ। আমরা আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রায় সবটুকুই নিজেরাই উৎপাদন করে থাকি। তাতে বলাই যায় যে আমাদের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কম তারপরেও বলা যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য আমাদের মুদ্রাস্ফীতি দেখতে হচ্ছে।
আমরা পদ্মা সেতুর মতো বিশাল একটি প্রজেক্ট বিদেশি কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই করতে পেরেছি। এটি আমাদের বিশাল একটি অর্জন। তাছাড়া চীন আমাদের দেশের প্রায় বেশিরভাগ প্রজেক্ট ই বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে। তবে এখানে আমাদের ভয় পাওয়ার মত কিছুই নেই। আমাদের দেশের প্রায় সকল প্রজেক্ট জয়েন্ট ভেঞ্চার অর্থাৎ একাধিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ নিয়ে তৈরি হচ্ছে।
তাছাড়া আমাদের কাছে আছে পর্যাপ্ত ডলার যা আমাদের বিদেশে অবস্থান করা রেমিটেন্স যোদ্ধারা আমাদের দেশে পাঠাচ্ছে। সে রেমিটেন্স এবং আমাদের রপ্তানি আয় দিয়েই আমাদের ঋণ সমূহ পরিশোধ সম্ভব।
সাময়িক সময়ে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা মান হ্রাস;-
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে বাংলাদেশ হতে পাচার হওয়া শত শত কোটি টাকার। পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনতে পারছি না। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের প্রত্যাশায় ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস নির্ভর থাকার ফলে গার্মেন্টস রপ্তানি হ্রাস পাওয়াতে বাংলাদেশের রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজন এককেন্দ্রিক শিল্প হতে বহুমুখী শিল্প কে উৎসাহিত করা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গুলো কি পুনরায় পুনর্জীবিত করা। এতে করে দেশের তৃণমূল থেকে দেশের উন্নয়ন সংঘটিত হবে।
সরকারের এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার আওতায় আনা। তাহলে দেশ হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায়। দেশের মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।
অসংখ্য ধন্যবাদ ধৈর্যসহকারে আমাদের এই ব্লগ টি পড়ার জন্য। ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। নিচের কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিতে পারেন আপনার কি মতামত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে। আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশে পরবর্তী শ্রীলংকা হতে যাচ্ছে?
জানাতে ভুলবেন না।
0 Comments